মদিনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা কর (২০০৭, ১১)

মদিনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আলোচনা কর (২০০৭, ১১)

ভূমিকাঃ- পৃথিবীর ইতিহাসে এবং ইসলামের ইতিহাসে মদিনা সনদ এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। মদিনা সনদ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠাতা করতে এবং সমাজের শান্তি শৃঙ্খলার বিধান নিশ্চিত করতে। মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করা হয় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর।

মূলত ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মহানবী সাঃ এর ঘোষিত মদিনা সনদ এর ধারণায় উদযাপিত হয়ে মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করা হয়। এ সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অশান্তি দূরীকরণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশে রচনার ক্ষেত্রে।

মদিনা সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মদিনা সনদ এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য ছিল অতুলনীয় বা অপরিসীম। মদিনা সনদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, ধর্মীয় ক্ষেত্রে, নৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে। এই সনদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিচে আলোচনা করা হলো।

প্রথম লিখিত সংবিধান

মদিনা সনদ পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান। হযরত মুহাম্মদ সাঃ ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ও বাস্তবায়িত করেন এই সনদ। মদিনা সনদের পূর্বে কার্যকৃত ও রচিত যে সকল আইন ছিল তার মধ্যে স্বৈরাচারী শাসক এর আদেশ এবং সরকার ছিল ব্যক্তিগত কেন্দ্রীভূত শাসন এর মধ্যে। এর সনদ রচনা হবার অনেক পরে ইংল্যান্ডে ম্যাগনাকার্টা রচনা করা হয়। ম্যাগনাকার্টার সাথে তুলনা করে মদিনা সনদ কে ম্যাগনাকার্টা বলা হয়

মহানবী সাঃ এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা

ইসলাম ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সাঃ নিজের নেতৃত্বকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। যে কারণে মূলত তিনি ইহুদি খ্রিস্টান মুসলিম ও ভিন্ন সম্প্রদায়কে একই নেতৃতীদের অধীনে নিয়ে আসার জন্য তার ধর্মীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠাতা সহজ করেন।

ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ

এই সনদের কারণে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাতার সুযোগ সৃষ্টি হয়। তৎকালীন সময়ে মদিনার সনদ কর্তৃক সকল গোত্র প্রথার বিলোপ সাধন করে। সে সময়ে স্বৈরাচারী শাসন বা শেখতন্ত্রের পরিবর্তে আল্লাহতালার সার্বভৌমত্বে নব্য প্রতিষ্ঠাতা ইসলামী প্রজাতন্ত্র স্বীকৃতি লাভ করে।

উদারনীতি

মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ সর্বদা উদার ছিলেন। তিনি সকল ধর্মের কথা চিন্তা করে সকল ধর্মের ব্যক্তিদের সাথে মিলেমিশে থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি কোন ধর্মকে ছোটভাবে দেখেন নাই। ইসলাম ধর্মকে কোন ধর্মের ওপর বা কোন মানুষের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া হয়নি।

তিনি ইসলাম ধর্ম অন্য কারোর উপর চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষেও ছিলেন না। তিনি মদিনা সনদে উল্লেখ করেন প্রত্যেক গোত্রের ব্যাক্তি নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারবে এবং স্বাধীনতা ভোগ করবে।

ভ্রাতৃসংঘ ও ঐক্য

মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবী সাঃ মুসলিম ও অমুসলিম সম্প্রদায় এর মধ্যে আবদ্ধ সৃষ্টি করেন, এ থেকে মুসলমান ও অমুসলিমদের মধ্যে হিংসা, বিদ্বেষ এর অবসান ঘটানো সম্ভব হয়। মদিনা সনদ এর আরো অনেক তাৎপর্য রয়েছে।

মহানবী সাঃ এর ক্ষমতা বৃদ্ধ

মদিনা সনদ এর মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তার সাথে ক্ষমতা ও বৃদ্ধি পায়। এ সনদ দ্বারা মহানবী সাঃ সম্পর্কে অনেক বিষয়ে জানা যায়। তার উদারতা সম্পর্কে এবং তার কর্ম ক্ষমতা সম্পর্কেও। মদিনার স্বতান্ত্রিক কর্তৃত্ব অর্পিত হয় মহানবী সাঃ এর উপর মদিনা সনদের দ্বারায়।

নাগরিক অধিকার অর্জন

মদিনা সনদে সকলের অধিকার সমানভাবে বন্টন করা হয়েছিল। কেউ বেশি সুযোগ-সুবিধা পাবে এবং কেউ কম সুযোগ-সুবিধা পাবে এমন কোন বিষয় ছিল না। সকলের সমান অধিকার ছিল। মদিনা সনদে যে নাগরিকদের সমান অধিকার ঘোষণা করা হয় সেটা মূলত আধুনিক গণতন্ত্রের পথিকৃত এবং বিশ্বের সম্পূর্ণ নতুন শাসন পদ্ধতি।

রাজনৈতিক ঐক্য

মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবি সাঃ মদিনা সনদের সকল গোত্রগুলোকে একটি গোত্রে পরিণত করে। সকল ক্ষেত্রে মানুষদেরকে একটি রাজনৈতিক ঐক্যে আবদ্ধ করেন। এই থেকে সে সময় এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্রগুলোর অবসান হয় এবং বৃহত্তর গোত্রের সৃষ্টি হয়। এ থেকেই বৃহত্তম স্বার্থে সনদে স্বাক্ষরকারীরা একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। এরই ফলস্রুতিতে যারা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী পরিচালনা করত তারা বৃহত্তর গোষ্ঠীর বা রাজনৈতিক প্রজাতন্ত্রের পরিচয় বহন করেন।

পূর্ণ গঠনে পরিকল্পনা

এই সনদে যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত আরব ভূমিকে এক করার জন্য একটি মহৎ পরিকল্পনা ছিল। মদিনা সনদে যে সকল সংঘর্ষ বিক্ষুদ্ধ হয়েছিল তার পূর্ণ গঠনে মহানবী সাঃ এই সনদে পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। সেই অনুযায়ী পুনরায় সবকিছু পূর্বের ন্যায় করা সম্ভব ছিল।

উপসংহারঃ- পরিশেষে আমরা উক্ত আলোচনা থেকে বুঝতে পারি যে মদিনা সনদের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। এটা মহানবী সঃ এর এক অন্যান্য সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বহিপ্রকাশ। এই সনদে মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন পরিচালনা করার জন্য এ সনদের নীতিমালা গৃহীত হয়েছে।  মদিনা সনদ আমাদের সকল মানুষের জন্য সকল যুগে এবং সকলকালেই অনুসরণযোগ্য।

মদিনা সনদে যে নীতিমালা গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তাতে রয়েছে সর্বপ্রকারের কল্যাণ। এ সনদ নিঃসন্দেহে মহানবী সাঃ এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, ধর্মীয় সহনশীলতা, জাতি গঠন, রাষ্ট্র গঠন, জীবন পরিচালনার মানবিক গুণাবলী প্রকাশ পায়। সুতরাং আমরা পরিশেষে বলতে পারি যে মদিনা সনদ মহানবী সাঃ এর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয়ক।

কমেন্ট

Previous Post Next Post